সুবর্ণজয়ন্তী কর্ণার

বাংলার সার্বভৌমত্ব ও বঙ্গবন্ধু

স্বাধীনতা মানে অন্যরকম সুখের এক অনুভূতি। এই অনুভবের ভেতরে থাকে ভয়হীন ও বাধাহীন এক মুক্ত সাড়ম্বর। ’৭১ সালের ৭ই মার্চ স্বাধীনতা শব্দের প্রথম প্রস্ফুটনের দৃশ্য দেখেছিলাম। তারপর ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে দুরুদুরু ভয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার বার্তা আনুষ্ঠানিক মুক্তি পায়। পরে ৯ মাস অজস্র রক্তের ভেতরে বাঙালির জীবন ও স্বাধীনতা শব্দটি সাঁতার কাটে। ১৬ই ডিসেম্বর ছিল অন্যরকম মুক্তির এক উল্লাসের দিন। সেদিনই অনুভব করেছিলাম স্বাধীনতা মানে শত্রুহীন ও বারুদের গন্ধহীন আঙ্গিনায় আমার অবাধ বিচরণের সুখ। এ সবই এখন ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের জনক।

 

বলা বাহুল্য, স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে সার্বভৌমত্ব। স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে নিজস্ব ভূখন্ড। স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে নিজস্ব জনগোষ্ঠীর। স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। 

 

কিন্তু আমাদের ইতিহাসে আমরা পাঠ করি যে, অমুক স্বাধীন নৃপতি ছিলেন। যেমন পাল বংশের সময়, পাল বংশ ছিল বাংলার স্বাধীন শাসক। পাল বংশ হচ্ছে বৌদ্ধধর্মের শাসকগোষ্ঠী। তখন অবশ্য বাংলা যে অর্থে বলা হয়, সে অর্থে এটাকে বলা যাবে না। পাল বংশ শাসন করেছে দীর্ঘ সময় এবং তাদের মধ্যে গোপাল নামের যে শাসক ছিলেন, তাকে বিখ্যাত শাসক বলা হয়। তিনি অনেক ভালো কাজ করেছেন। কিন্তু দেব পালের সময় তারা সেনদের কাছে হেরে যান। তারপর সেন বংশ শাসন শুরু করে। 

 

সুলতানি আমলে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহর নাম উল্লেখযোগ্য। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহও একটি বড় কাজ করেছিলেন। তিনি সে সময় বিচ্ছিন্ন অনেক অঞ্চল দখল করেছিলেন এবং সেগুলোকে একটি শাসনের অধীনে আনার চেষ্টা করেছেন। আমরা আলাউদ্দিন হোসেন শাহর কথাও বলি, যাকে বিদ্যাপতি পঞ্চগৌড়ের সম্রাট হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এই কজন তো খুব বিখ্যাত শাসক। শেষাবধি সিরাজউদ্দৌলাকে বলি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। সবই ইতিহাসের বিপ্রতীপ কথাবার্তা। 

 

কিন্তু এই অঞ্চলের কোনো শাসকেরই সার্বভৌমত্ব ছিল না। কারণ তারা হয় নিজেদের রাজ্য বিস্তার করেছেন কিংবা নিজেদের রাজ্য রক্ষা করার জন্য অন্য রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছন। যদি তাদের অধীনে রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে, তাহলে পাল বংশের পরে সেন বংশ কেন আবার নতুন করে সেই রাষ্ট্র দখল করল? কিংবা যদি শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহও স্বাধীন বাংলার শাসক হয়ে থাকেন, তাহলে তাকে কেন ফিরোজ শাহ থুঘলকের আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে একডালা দুর্গে আশ্রয় নিতে হলো? আলাউদ্দিন হোসেন শাহকে কেন চুক্তি করতে হলো সিকান্দার লোদির সঙ্গে? এ সবই হচ্ছে সার্বভৌমত্বহীনতার কারণে। অর্থাৎ, সার্বভৌমত্ব থাকলে একটি রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রকে আক্রমণ করতে পারে না। তার নিজস্ব ভূখন্ডে অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারে না এবং আন্তর্জাতিকভাবে এটা স্বীকৃত। আর তাই বলি, সেই সার্বভৌমত্ব বাঙালির কখনো ছিল না।

 

সার্বভৌমত্ব নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। Independence নিয়ে অনেক শর্ত আছে। সার্বভৌমত্বের প্রথম ধারণাটি, যেটি সুসংবদ্ধ ধারণা, সেটাকে Westphalian treaty বলা হয়। এটি জার্মানিতে হয়েছিল। Westphalian treaty ইউরোপের দেশগুলোর সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য হয়েছিল। তখন তারা এই Treaty-র মাধ্যমে স্বীকার করেছিল যে, ফ্রান্স, জার্মানি, রোমান অ্যাম্পিয়ার, ডাচ রিপাবলিক-এই দেশগুলোর নিজস্ব অখন্ড যে সত্তা, নিজস্ব যে Territorial integrity, সেটির প্রতি তারা সম্মান প্রদর্শন করবে এবং এভাবেই সেই দেশগুলোর সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হয়েছিল। 

 

আগে এই উপমহাদেশে কোনো কোনো স্বাধীন নৃপতি ছিলেন কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু স্বাধীন দেশের নৃপতি হিসেবে ছিলেন না। কারণ তাদের কারোরই সেই সার্বভৌমত্ব ছিল না। তাই বলতে পারি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হচ্ছেন প্রথম সার্বভৌম শাসক, যিনি বাংলাদেশ নামের এক জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং শাসন করেছেন। 

 

‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু শেষ কথাটি লিখেছেন এভাবে,- ‘আমার মতে, ভাত-কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে, সাথে সাথে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই। তা না হলে মানুষের জীবন বোধ হয় পাথরের মতো শুষ্ক হয়ে যায়।’

 

আমাদের প্রত্যাশার স্বাধীনতা এখন আমাদের বুকের কাছে মুখ রেখে আদর্শের কোনো অপূর্ণতার কথা বলে কিনা, তার মূল্যায়ন করা আবশ্যক।